কল্পনা চাকমা - Kalpana Chakma - SMH Amiri

সর্বশেষ লিখাসমূহ

কল্পনা চাকমা - Kalpana Chakma

"পাহাড়ে যে অত্যাচার করা হয় পরীক্ষামূলকভাবে, একসময় সেই নীপিড়ন নেমে আসে সমতলে।"  - কল্পনা চাকমা

কল্পনা চাকমা ছিলেন মানবাধিকারকর্মী এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর আঞ্চলিক সংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদক। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন তিনি নিজ বাড়ি থেকে পরিবারের সদস্যদের সামনে অপহৃত হন। দীর্ঘ ২৮ বছর পর চলতি বছরের ২৩ এপ্রিল ২০২৪ রাঙ্গামাটির আদালত অপহরণের মামলাটি খারিজ করে দেয়।

রাজনীতি, আন্দোলন ও নেতৃত্বে স্বল্প সময়ের মধ্যেই দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি। ফলে তার অপহরণ ঘটনা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের আঞ্চলিক সংগঠনগুলো জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলে। অপহরণের পরদিন কল্পনা চাকমার বড় ভাই কালিন্দী কুমার চাকমা বাদী হয়ে স্থানীয় থানায় একটি মামলা করেন।

সে সময়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মো. আবদুল জলিলকে প্রধান করে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছিল। কমিশন ৯৪ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেও এ অপহরণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কাউকে শনাক্ত করতে পারেনি। তবে সরকার সেই তদন্ত প্রতিবেদন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশও করেনি। মামলা দায়েরের ১৪ বছর পর ২০১০ সালের ২১ মে মামলাটির প্রথম চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। ১৪ বছর তদন্তাধীন থাকার পর চূড়ান্ত প্রতিবেদনে আসামিদের অজ্ঞাতনামা উল্লেখ করে তা দাখিল করা হয়। বাদী ওই প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করে নারাজি দিলে পরবর্তী সময়ে অধিকতর তদন্তের জন্য আদালত মামলাটি সিআইডির কাছে হস্তান্তর করেন। সিআইডি দুই বছর সময় নিয়ে অবশেষে ২০১২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তাদের চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করে।সব মিলিয়ে এ ঘটনার তদন্ত হয়েছে তিনবার। এর মধ্যে দুবার তদন্ত করেছে সিআইডি। তাতে দু’বারই নারাজি আবেদন করে কল্পনা চাকমার পরিবার।

সর্বশেষ রাঙামাটির পুলিশ সুপার আমেনা বেগমের দেয়া তদন্ত রিপোর্টও প্রত্যাখ্যান করে মামলার বাদী। অপহরণের পর থেকে মামলার বাদী ও পাহাড়ি সংগঠনগুলো অপহরণের জন্য এক সেনা কর্মকর্তা লে. ফেরদৌস ও তিনজন ভিডিপি সদস্যকে দায়ী করে। কিন্তু দীর্ঘ ১৮ বছরের একাধিক তদন্ত প্রতিবেদনে অভিযুক্তদের নাম না আসায় ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের দাবী জানিয়ে নারাজি আবেদন দিয়ে যাচ্ছেন মামলার বাদী। বর্তমানে কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলাটি রাঙামাটি জেলা পুলিশ সুপারের অধীনে পুনঃ তদন্তাধীন।


রাঙামাটির বর্তমান পুলিশ সুপার সাইদ তারিকুল হাসানের কাছে এ মামলার তদন্তের সর্বশেষ অগ্রগতি জানতে চাইলে তিনি আবারো বলেন, ‘মামলাটি তদন্তাধীন। আদালতের নির্দেশে মামলার তদন্ত কাজ চলছে। আদালত যেসকল বিষয়ে আলাদা আলাদা করে অবজারভেশন নিয়ে তদন্ত করতে বলেছে আমরা সেগুলো তদন্ত করছি। এটি অনেক পুরাতন মামলা। তাই সময় লাগছে’।

কল্পনা চাকমার অপহরণের তদন্ত নিয়ে যেমন দীর্ঘসূত্রিতা হয়েছে। তেমনি জিইয়ে থাকার সুযোগে একটি মহল এই মামলাকে সামনে রেখে গত ২০ বছর ধরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঙালী ও সেনাবাহিনীর অবস্থান নিয়ে দেশে বিদেশে ব্যাপক প্রপাগাণ্ডা চালিয়েছে যার বেশিরভাগই মিথ্যা।

উদাহরণ স্বরূপ, চলছি বছর জুন মাসের শুরু থেকে পাহাড়ীদের বিভিন্ন ওয়েব সাইট ও ফেসবুক পেইজে বলা হয়, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল কল্পনা চাকমার বিচার দাবীতে বাংলাদেশ সরকারের উপর চাপ সৃষ্টির লক্ষে ‘ফটো একশন’ নামে একটি ক্যাম্পেইন চালু করেছে। এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের লোগোসহ কল্পনা চাকমার ছবি হাতে নিয়ে তা পাঠাতে বলা হয়েছে। কিন্তু এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ওয়েবসাইট খুঁজে এ ধরনের কোনো ক্যাম্পেইনের খবর পাওয়া যায়নি। অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, একটি মহল থেকে এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের লোগো ও কল্পনা চাকমা ছবি দিয়ে একটি এ্যাপ তৈরী করা হয়েছে। এ্যাপটিতে নিজের ছবি লাগিয়ে পোস্ট করলে আয়োজকরা বিভিন্ন সামাজিক গণমাধ্যমে এমনেস্টির লোগোসহ ব্যাক্তির ছবির সাথে কল্পনা চাকমার ছবি প্রচার করছে। অথচ এই প্রপাগাণ্ডায় ব্যবহার করা হচ্ছে এমনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের নাম।


প্রশ্ন হচ্ছে, কল্পনা চাকমা কোথায়? তিনি কি আদৌ অপহৃত হয়েছিলেন? তিনি কি সেনাবাহিনীর সদস্য কর্তৃক অপহৃত হয়েছিলেন? তিনি কি স্বজন বা পরিচিত কারো দ্বারা অপহৃত হয়েছিলেন? তিনি কি মারা গেছেন? তিনি কি বেঁচে আছেন? বেঁচে থাকলে কোথায় আছেন? — এমন প্রশ্ন বিগত ২০ বছর ধরেই ঘুরপাক খাচ্ছে জনমনে।

পার্বত্যনিউজের তরফে এসকল প্রশ্নের সমাধান খুঁজতে গিয়ে বিগত ২০ বছরের অনেক তথ্য, উপাত্ত, প্রমাণ, রিপোর্ট, বর্ণণা আমাদের পরীক্ষা করে দেখতে হয়। এই মামলা নিয়ে কাজ করেছেন, শুরু থেকে মামলা পর্যবেক্ষণ করেছেন এমন কিছু লোকের সাথেও কথা হয়।

রাঙামাটি জেলার একজন আইনজীবী শুরু থেকেই কল্পনা চাকমা অপহরণের ঘটনাবলীর উপর নজর রেখেছিলেন। নিরাপত্তার কারণে না প্রকাশ না করার শর্তে পার্বত্যনিউজকে বলেন, কল্পনা চাকমার অপহরণ তদন্ত করতে গেলে ঘটনার সময় বিচার করা জরুরী। তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাঙ্গামাটি জেলায় পাহাড়ী সংগঠনগুলো নিজস্ব প্রার্থী হিসেবে তাদের অঙ্গ সংগঠন পাহাড়ী গণপরিষদ কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম সদস্য বিজয় কেতন চাকমাকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে (প্রজাপতি মার্কা) দাঁড় করায়। তার পক্ষে প্রচারণা চালানোর জন্য তাদের প্রকাশ্য সংগঠন পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ (পিসিপি), পাহাড়ী গণপরিষদ (পিজিপি) ও হিল উইমেন ফেডারেশন (এইচডব্লিউএফ)কে নির্দেশ দেয়। অপরদিকে রাঙামাটিতে আওয়ামীলীগ মনোনীত প্রার্থী দীপংকর তালুকদারের পক্ষে নাগরিক কমিটিসহ বেশিরভাগ ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠী ও বাঙ্গালী জনগন সমর্থন দেয় এবং প্রচারণায় নামে । তৎকালীন শান্তিবাহিনীর দোসর পিসিপি, পিজিপি ও এইচডব্লিউএফ দীপংকর তালুকদারের জনপ্রিয়তায় শঙ্কিত হয়ে তার সমর্থক বিভিন্ন নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ ও সাধারণ উপজাতীয়দের হুমকি দেয়া ও হয়রানি করা শুরু করে । পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, পাহাড়ী সন্ত্রাসীরা সেসময় সমগ্র পার্বত্যাঞ্চলে প্রায় ৩৫ জন আওয়ামীলীগ সমর্থককে নির্বাচনের আগে ও পরে অপহরণ করে । এদিকে কল্পনা চাকমা আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীর হয়ে প্রচার কাজ চালাচ্ছিলেন যদিও তিনি হিল উইমেন ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদিকা ছিলেন। এসব মিলিয়ে ঘটনাটি তাদের উপদলীয় কোন্দলের সৃষ্টি করেছিল এবং তাকে উক্ত প্রচার থেকে বিরত থাকার জন্য সন্ত্রাসীরা বেশ কয়েকবার হুমকিও দিয়েছিল। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীর জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে কল্পনা চাকমাকে অপহরণের নাটক সাজিয়ে শান্তিবাহিনী ও পিসিপি ভোটের পূর্বের রাতে তাৎক্ষণিক একটি ইস্যু তৈরি করে নির্বাচনে জনমতকে তাদের পক্ষে নিয়ে যাবার অপচেষ্টা চালিয়েছিল।


উক্ত ঘটনার আকষ্মিকতায় এমন পরিস্থিতি তৈরী হয়েছিল যে, প্রিজাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসারদের তথ্য মতে, পাহাড়ী ভোটাররা সকাল ৮ ঘটিকায় ভোট কেন্দ্রে উপস্থিত থাকা সত্ত্বেও ভোট দেয়া থেকে বেশ কিছুক্ষণ বিরত থাকেন। ঐ সময় প্রার্থী নির্বাচনে তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বিলম্ব করেন বলেও জানা যায়।

পুরাতন তথ্য বিশ্লেষণ করে ওই আইনজীবী আরো জানান, এরপর ১৭ জুন ১৯৯৬ তারিখ পাহাড়ী গণপরিষদ, পাহাড়ী ছাত্র পরিষদ এবং হিল উইমেন ফেডারেশন কর্তৃক জেলা প্রশাসক বরাবর একটি স্বারকলিপি প্রেরণ করে। কল্পনা চাকমার অপহরণের জন্য সংগঠনগুলো তৎকালীন উগলছড়ি ক্যাম্পের ক্যাম্প কমান্ডার লে. ফেরদৌসকে দায়ী করেন। সংগঠনগুলোর ভাষ্য মতে, ঐদিন দিবাগত রাতে উক্ত কর্মকর্তাসহ নিরাপত্তাবাহিনীর ৮/৯ জন সদস্য উগলছড়ি আর্মি ক্যাম্প থেকে নিউ লাইল্লাঘোনায় এসে জোরপূর্বক কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করে।

ঘটনার সময় খাগড়াছড়িতে কর্মরত ছিলেন এমন একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্মকর্তা পার্বত্যনিউজকে বলেন, লে. ফেরদৌস কচুছড়ি আর্মি ক্যাম্পে ক্যাম্প কমান্ডারের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন । তিনি ১১ জুন ১৯৯৬ তারিখে কচুছড়ি সেনা ক্যাম্প থেকে একটি টহল দলকে নেতৃত্ব দিয়ে উগলছড়ি সেনা ক্যাম্পে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ডিউটির জন্য আসেন। তার সাথে আরও তিনজন কর্মকর্তা উগলছড়ি ক্যাম্পে রাত্রিযাপন করেন । ফেরদৌস তার টহলদল ও নির্বাচনী কর্মকর্তাদের নিয়ে ১২ জুন ১৯৯৬ তারিখ সকাল সাতটায় নির্বাচনী দায়িত্ব পালনের উদ্দেশ্যে ক্যাম্প থেকে পোলিং সেন্টারের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যান।

তিনি আরো বলেন, লে. ফেরদৌস শান্তিবাহিনীর অবৈধ কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সাফল্যজনক কয়েকটি অপারেশন পরিচালনা করেন । ঘটনার কিছুদিন পূর্বে বাঘাইছড়ি ইউনিয়নের প্রাক্তন চেয়ারম্যান সম্রাট সুর চাকমার বাড়ীতে অবৈধ চাঁদা আদায়কারীদের অবস্থানের খবর পেয়ে তিনি একটি তল্লাশী অভিযান চালান । এছাড়াও তিনি আরেকটি অপারেশন চালিয়ে পিসিপির দুইজন অবৈধ চাঁদাবাজকে হাতেনাতে গ্রেফতার করেন । এরপর থেকে সম্রাট সুর চাকমা ও পিসিপি লে. ফেরদৌসকে শায়েস্তা করার জন্য নানা চেষ্টা করে আসছিলেন। তার এই অপারেশন কার্যক্রমে দিশেহারা হয়ে শান্তিবাহিনী ও পিসিপি তার পেট্রোল এর উপর বেশ কয়েকবার এম্বুশ করেও তার কোন ক্ষতি করতে পারেনি। দুঃসাহসিক ও নিবেদিত প্রাণ এই কর্মকর্তা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তার অপারেশনাল কর্মকাণ্ড নিষ্ঠার সাথে পালন করে যাচ্ছিলেন। উপায়ান্তর না দেখে উক্ত অফিসার তথা সেনাবাহিনীকে ঘায়েল করার ভিন্ন পথ খুঁজে নেয় পাহাড়ী সন্ত্রাসীরা। তারা মিথ্যা অভিযোগ ও অপপ্রচারের অস্ত্র ব্যবহার করার পরিকল্পনা ফাঁদে।

ঘটনার পর তদন্ত করতে গিয়ে কল্পনা চাকমার বাড়ীতে তার পরিধেয় বস্ত্র, বইপুস্তক ও নিত্য ব্যবহার্য কোন সামগ্রী খুঁজে পায়নি তদন্ত কমিটি। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে তিনি অপহৃত হয়েছেন, নাকি স্বেচ্ছায় আত্মগোপন করে নিরাপত্তা বাহিনীকে জড়িয়ে একটি ইস্যু তৈরি করেছেন । এ যাবত পরিচালিত কোন তদন্তেই কল্পনা চাকমা অপহৃত হয়েছেন এমন কোন আলামত পাওয়া যায়নি। পাওয়া যায়নি কথিত অপহরণের সাথে নিরাপত্তাবাহিনীর সংশ্লিষ্টতার কোন প্রমাণ।

কল্পনা চাকমার অপহরণ ঘটনা নিয়ে একটি স্বতন্ত্র তদন্ত করেছিল তৎকালীন মানবাধিকার কমিশন। এ তদন্তের বিষয়ে ১৯৯৬ সালের ৮ আগস্ট রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে তদন্তের নানা তথ্য, উপাত্ত, ভিডিও প্রদর্শন করেন। সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালক ও জাতীয় সমন্বয়কারী এডভোকেট কে এম হক কায়সার বলেছেন, “পূর্ব পরিকল্পিতভাবে তারই লোকজন দ্বারা কল্পনা চাকমা নিখোঁজ রয়েছে। লে. ফেরদৌস অথবা অন্য কোনো সামরিক বাহিনীর সদস্যই যে, এই ঘটনার সাথে জড়িত নয় তা কল্পনা চাকমার মা, আত্মীয় স্বজন ও স্থানীয় জনগণের বক্তব্যে প্রকাশ পায়। তিনি আরো বলেন, কল্পনা চাকমা বর্তমানে ত্রিপুরা রাজ্যের গণ্ডাছড়া মহকুমার শুক্রে নামক স্থানে অবস্থান করছে। ….বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশন আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত প্রতিবেদন পাঠ করেন, সংগঠনের অবৈতনিক নির্বাহী পরিচালক ও জাতীয় সমন্বয়কারী এডভোকেট কে এম হক কায়সার। অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এসোসিয়েট প্রফেসর ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ, সাইফুল ইসলাম দিলদার, মুনির উদ্দীন খান, সুপ্রীম কোর্টের এডভোকেট ইতরাত আমিন, মানবাধিকার গবেষণা সহকারী সাহেলা পারভীন লুনা। বিভিন্ন তথ্য প্রমাণসহ লিখিত বক্তব্যে বলা হয়, কল্পনা চাকমা শেষ কবে মার সাথে যোগাযাগ করেছে, এই প্রশ্নের জবাবে মা বাধনী চাকমা জানান, নিখোঁজ হওয়ার পর দুই বার যোগাযোগ করেছে, এবং সর্বশেষে যোগাযোগ হয়েছে ১ আগস্ট ’৯৬। এতে প্রমাণিত হয় যে, কল্পনা চাকমা বেঁচে আছেন এবং কোথায় আছেন তা তার মা বেশ ভাল ভাবেই জানেন।”দৈনিক মিল্লাত ৯ আগস্ট, ১৯৯৬।

প্রকৃতপক্ষে কল্পনা চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে একটি মিস্টিরিয়াস ক্যারেক্টার। প্রকৃতপক্ষে তিনি অপহৃত হয়েছেন, পালিয়ে গিয়েছেন, ধর্ষিতা হয়েছিলেন, মারা গিয়েছেন নাকি বেঁচে আছেন এ নিয়ে রয়েছে রহস্যের বিশাল ধুম্রজাল। দেশের স্বার্থে, পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি, সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, জাতীয় মর্যাদার স্বার্থে এই রহস্যের উদঘাটন জরুরী। কল্পনা চাকমা অপহরণ মামলা ঝুলে থাকা জাতির জন্য কল্যাণকর হচ্ছে না। তাই দ্রুত গতিতে এই মামলার তদন্ত ও বিচারকাজ সমাপ্ত করে এই ঘটনার সাথে যারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান জরুরী।


মূদ্রার অন্যপিঠে যা বলা হয়ে থাকে

----------------------------------------------------------------------------------------------------

কল্পনা চাকমার সবচেয়ে বড় পরিচয় হল তিনি ছিলেন তৎকালীন শান্তিবাহিনীর অঙ্গ সংগঠন হিল উইমেন ফেডারেশনের সাংগঠনিক সম্পাদিকা। রাজনৈতিক, আন্দোলন ও নেতৃত্বে স্বল্প সময়ের মধ্যেই দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু  এই নেতৃত্ব কল্পনা চাকমা বেশিদিন চালিয়ে যেতে পারেননি। ১৯৯৬ সালে ১১ জুন মধ্যরাতে নিজ বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়ে যান তিনি। অবশ্য কেউ কেউ বলে তাকে অপহরণ করা হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলেন তিনি স্বেচ্ছায় অন্তর্ধান হয়েছেন। জেনে নেয়া যাক অনুসন্ধান কি বলে:

কল্পনা চাকমার প্রেমিক (পরবর্তীতে স্বামী) অরুণ বিকাশ চাকমা ভারতের অরুণাচল প্রদেশের ভারতীয় রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের সাথে জড়িত ছিলেন। অরুণ চাকমা বেশ কয়েকবার কল্পনা চাকমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন। কল্পনা এবং অরুণ দুজনের মধ্যে ভালবাসার সম্পর্কও গড়ে উঠেছিল। এই সম্পর্কের কথা কল্পনার বাড়িতে জানাজানি হলে কল্পনার পরিবার সে সম্পর্ককে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়।

কল্পনা চাকমা ও তার স্বামী

অপরদিকে তৎকালীন তরুণ সেনা অফিসার লে. ফেরদৌস বেশ কিছু সফল অপারেশন পরিচালনার মাধ্যমে শান্তিবাহিনী এবং পিসিপির মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করেন। তিনি ছিলেন উগলছড়ি ক্যাম্পের ক্যাম্প কমান্ডার। নির্বাচনের উদ্দেশ্যে তার ঐ ক্যাম্পে আগমন। খুব তাড়াতাড়ি তার এই সফলতা শান্তিবাহিনী এবং পিসিপির মধ্যে চিন্তার উদ্রেক করে। পরবর্তিতে তাকে প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে তার গাড়ির বহরের উপর বেশ কয়েকবার এম্বুশ করে পিসিপি এবং শান্তিবাহিনী। কিন্তু তার কোন ক্ষতি করতে পারে নি তারা। ফলে তারা ফন্দি আটতে থাকে কিভাবে লে. ফেরদৌসকে কোন বিতর্কে জড়িয়ে তাকে এলাকা ছাড়া করা যায়।

অপরদিকে কল্পনা চাকমা হিল উইমেন ফেডারেশানের সদস্য এবং তাদের নিজস্ব প্রার্থী বিজয় কেতন চাকমার প্রচার চালানোর দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়া সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের প্রচার চালাচ্ছিলেন। যার কারণে তিনি অতি দ্রুত সবার নজরে চলে আসেন। ফলে ‘সতীনের ছেলেকে বাঘ মারতে পাঠানোর‘ বাংলা প্রবাদের মতো তাকে ঘিরেই ষড়যন্ত্র পরিকল্পনা সাজায় আঞ্চলিক সংগঠনটি। বিষয়টি টের পেয়ে তৎকালীন শান্তিবাহিনী ও পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি)‘র কতিপয় শুভাকাঙ্ক্ষীর সহায়তায় এবং পরিকল্পনায় প্রেমিক অরুণ বিকাশ চাকমার কাছে কল্পনা চাকমা পালিয়ে যান। যাকে অনেকটা স্বেচ্ছায় অন্তর্ধান বলা যায়। বিষয়টি তার পরিবারের সকলেই জানে।

এ ঘটনায় প্লট পরিবর্তন করে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্য শান্তিবাহিনী এবং পিসিপি সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে মিথ্যা অপহরনের নাটক মঞ্চস্থ করে। যার প্রথম ধাপ ছিল ১২ জুন ১৯৯৬ তারিখে কল্পনা চাকমার ভাই কালিন্দা কুমার চাকমা বাঘাইছড়ি থানার মামলা (মামলা নং-২/৯৬১)।

পরবর্তীতে কল্পনা চাকমা নিখোঁজের ব্যাপারটিকে নিয়ে তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। এক পর্যায়ে তদন্ত কমিশন কল্পনা চাকমার মাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে কল্পনা চাকমার মা শান্তিবাহিনী ও পিসিপির চাপে পরে উপরোক্ত ঘটনাটি আড়াল করেন এবং তদন্ত কমিটিকে জানায়, যে রাতের বেলা কিছু লোক অস্ত্র হাতে, লুঙ্গি পরিহিত অবস্থায় তার বাড়িতে দরজা কেটে প্রবেশ করে কল্পনাকে নিয়ে যান। সাথে কল্পনার দুই ভাইকেও নিয়ে যায়। কিছুদূর নিয়ে যাওয়ার পর তার ভাইদের পাঠিয়ে দেয় এবং তৎক্ষণাৎ তার মা তিনটি গুলির আওয়াজ পান। এখানে মজার ব্যাপার হল যে, গুলির আওয়াজ তিনি একাই পেয়েছিলেন। তার আশেপাশের কেউ এই আওয়াজ পান নি। তিনি আরো বলেন যে, ‘যারা এসেছিল তাদের কন্ঠস্বর নাকি সেনাবাহিনীর মত‘। যাই হোক, সময়ের সাথে চলতে থাকে তদন্তের কার্যক্রম।

এলাকাবাসীর মন্তব্য এবং কল্পনার পরিবারের কথায় যখন তদন্ত কমিটি সন্দিহান হয়ে পড়ে। ঠিক তখনই ১ আগস্ট ১৯৯৬ তারিখে কল্পনা তার মার সাথে যোগাযোগ করে এবং জানায় যে, সে ভাল আছে। (বিষয়টি দৈনিক মিল্লাত পত্রিকায় প্রকাশিত)

৮ আগস্ট ১৯৯৬ তারিখে কল্পনা চাকমাকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের গংগাছড়া মহাকুমার ৪ মাইলের শুক্রে নামক এলাকায় দেখা যায়।

৯ আগষ্ট ১৯৯৬ তারিখে বিভিন্ন পত্রিকায় কল্পনা চাকমা বেঁচে আছে বলে খবর প্রকাশিত হয়। এবং শুধু তাই নয়, কিছু কিছু পত্রিকায় সেনাবাহিনীর কোন সম্পৃত্ততা নেই বলে মত প্রকাশ করে।

২০ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬ তারিখে অরুণাচল থেকে লিখিত একটি চিঠিতে কল্পনা চাকমা উল্লেখ করেন যে, প্রায় দেড় মাস খানেক আগে তিনি মা হয়েছেন। তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, আত্মীয়দের স্বজনদের নিষেধ অমান্য করে বিয়ে করায় নিজের মাতৃভূমি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন।

১৪ জুন ১৯৯৬ তারিখে প্রকাশিত প্রথম আলোর একটি লেখাকে সূত্র হিসেবে উল্লেখ করে হিল উইমেন্স ফেডারেশন একটি লিফলেট (১০ জুন ২০০৬) বিতরণ করে। যেখানে তারা দাবি করে, ত্রিপুরার এক সেনা কর্মকর্তা সাংবাদিক আবেদ খানকে নিশ্চিত করেছেন যে, কল্পনা চাকমাকে সেনাগোয়েন্দারা ত্রিপুরায় অক্ষত অবস্থায় দেখে এসেছে। এমনকি কল্পনা চাকমা অবশ্যই বেঁচে আছে এ খবর নিশ্চিত করেছেন।

তদন্তের স্বার্থে তদন্ত কমিটি যখন কল্পনা চাকমার বাসায় যায় তখন তার ব্যবহৃত কোন প্রকার ব্যবহার্য দ্রব্য পাওয়া যায় নি। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে, অপহরণকারীরা যদি অসৎ কোনো উদ্দেশ্যেই তাকে তুলে নিয়ে যাবে তাহলে তার ব্যবহার্য দ্রব্যাদি কেন নিয়ে যাবে?

শুধু তাই নয়, তদন্ত কমিটি এক পর্যায়ে কল্পনা চাকমার ভারতে থাকার সুত্র পান এবং তাকে দেশে ফিরে আসার জন্য চিঠি লিখেন। ফিরতি চিঠিতে কল্পনা চাকমা লিখেন, তিনি ফিরে আসতে চান। কিন্তু ফিরে আসলে শান্তিবাহিনী তাকে হত্যা করে ফেলবে। এই ভীতি থেকেই তিনি দেশে আসেন না।

উপরক্ত বিষয়গুলো পর্যালচনা করলে দেখা যায়, কল্পনা চাকমা আসলে নিজে নিজেই পালিয়ে গিয়েছিলেন। যার কারণ দুইটি। একটি হল তার ভালবাসাকে তার পরিবার বিবাহের সম্পর্কে আবদ্ধ করতে চান নি এবং শান্তিবাহিনীর একটি চাপ। কারণ এখন সে যদি দেশে ফিরে আসে তাহলে শান্তিবাহিনীর সকল বানোয়াট ঘটনা ফাঁস হয়ে যাবে।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে উপসংহারে পৌঁছানো যায় যে, কল্পনা চাকমা অপহরণ নিয়ে শান্তিবাহিনী এবং পিসিপির সকল প্রকার প্রচারণাই ভুল এবং বানোয়াট। তাই সকলের উচিত এই ভুল প্রচারণাকে উৎসাহিত না করা। কেননা, কল্পনা চাকমা এখনো বেঁচে আছেন এবং বেশ ভাল আছেন।


সূত্র:

১। বাঁধ বাঙার আওয়াজ

২। উইকিপিডিয়া

৩। প্রভাতনিউজ

৪। প্রথম আলো

৫। বাংলা ট্রিবিউন

৬। বিডিনিউজ২৪