থাই সামরিক বাহিনী এবং সেদেশের দক্ষিণাঞ্চলের মুসলিম বিদ্রোহীদের মধ্যে গত প্রায় দুই দশক ধরে সংঘাত চলছে৷ মাঝখানে কিছুদিন সহিংসতা কম হলেও এখন আবার পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠার আশঙ্কা করা হচ্ছে৷ থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলের সংঘাতপ্রবণ এলাকার এক চেকপয়েন্টের কাছে ছবি তুলছিলেন এক সাংবাদিক৷ তাঁকে থামাতে দ্রুত সেখানে হাজির হন এক নিরাপত্তারক্ষী৷ সাংবাদিকের পরিচয় জানার পর অবশ্য শান্ত হন নিরাপত্তারক্ষী৷ চেকপয়েন্টে ঝুলিয়ে রাখা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ছবির দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, "বিদ্রোহীরা যে ক্রমাগত কতটা নৃশংসতা চালাচ্ছে, তা আমার পক্ষে ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন৷" তিনি বলেন, "রাজার মৃত্যুর পর কিছুদিন সবকিছু শান্ত ছিল৷ কিন্তু এখন আবার সহিংসতা শুরু হয়েছে৷"
সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে, আমরা জানি না কখন এবং কোথায় বিচ্ছিন্নতাবাদীরা পরবর্তী হামলা চালাবে৷ তারা বিশেষ কোনো পোশাক বা প্রতীক ব্যবহার না করায় সাধারণ জনতা থেকে তাদের আলাদা করা এক দুরূহ ব্যাপার৷''
থাইল্যান্ডে প্রায় সাত কোটি জনসংখ্যার প্রতি ২০ জনের একজন মুসলমান। দেশটিতে ৯৫ লাখের বেশি মুসলমান রয়েছে। যাদের বেশির ভাগই বাস করেন গ্রামাঞ্চলে। মুসলিমরা থাইল্যান্ডের বৃহত্তম সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী। আরব ব্যবসায়ী এবং ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মুসলিম অভিযানের মাধ্যমে এদেশে ইসলামের বিস্তার ঘটে। থাইল্যান্ডের মুসলিম প্রধান তিনটি রাজ্য হলো- পাত্তানি, নারাথিওয়াট ও ইয়ালা। এই তিনটি প্রদেশে থাইল্যান্ডের মোট মুসলিম জনসংখ্যার ১৮ শতাংশ বাস করেন। বিগত এক শতাব্দী আগে থাইল্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত এটি স্বাধীন মুসলিম সালতানাত হিসেবে পরিচিত ছিল। এ ছাড়া মালয়েশিয়া সংলগ্ন সাতুন প্রদেশেও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে।
মালয়েশিয়ার সীমান্ত সংলগ্ন থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলে গত কয়েকমাস ধরে প্রায় প্রতিদিনই বিচ্ছিন্নভাবে বোমা বিস্ফোরণ এবং গোলাগুলির ঘটনা ঘটছে৷ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মূল লক্ষ্য সেনা এবং নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা৷ সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে অস্থিরতার দিকে নজর রাখা বেসরকারি উন্নয়নসংস্থা ‘ডিপ সাউথ ওয়াচ' জানিয়েছে, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সহিংসতার শিকারের সংখ্যা বেড়েছে৷
পাটানি, ইয়ালা এবং নারাথওয়াত রাজ্যকেথাইল্যান্ডের ‘ডিপ সাউথ' হিসেবে বিবেচনা করা হয়৷বৌদ্ধপ্রধান দেশটির এই রাজ্যগুলোতে মুসলমানদের বসবাস বেশি৷ গত দুই দশক ধরে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দাবি হচ্ছে, এই রাজ্যগুলোকে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দিতে হবে৷ কিন্তু থাই সরকার সেই দাবি মেনে নেয়নি৷ বরং দেশটির সেনাবাহিনী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনে কড়া পদক্ষেপ নিয়েছে৷
উল্লেখ্য, ২০০৪ সাল থেকে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে নিয়মিত সহিংস ঘটনা ঘটতে শুরু করে৷ আর তখন থেকে এখন অবধি বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং থাই সরকারের মধ্যে সংঘাতে প্রাণ হারিয়েছেন সাত হাজারের মতো মানুষ৷ আহত হয়েছেন চৌদ্দ হাজারের মতো৷ মাঝখানে সহিংসতা কমলেও অস্থির পরিস্থিতির অবসানের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না৷ বরং যে-কোনো সময় পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে৷
শ্রীলংকা, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে প্রায়ই মুসলিমবিরোধী মনোভাব দেখা যায়৷ বৌদ্ধ ভিক্ষুদের একটি অংশের প্ররোচণা এর জন্য দায়ী বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা৷ কয়েকদিন আগে শ্রীলংকার ক্যান্ডিতে চার মুসলমানের হামলায় এক বৌদ্ধ নাগরিকের আহত হওয়ার অভিযোগকে কেন্দ্র করে মুসলমানদের মসজিদ, ঘরবাড়ি ও ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানে হামলা চালানো হয়েছিল৷ পরিস্থিতি সামাল দিতে দেশটিতে জরুরি অবস্থা জারি করেছিল সরকার৷ এছাড়া ১২ দিনের জন্য সামাজিক মাধ্যম বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল৷ কারণ, ‘বুদ্ধিস্ট ফোর্স' নামে ভিক্ষুদের একটি সংগঠনসহ মৌলবাদী বৌদ্ধরা মুসলিমদের উপর হামলা চালাতে মানুষজনকে উৎসাহী করতে সামাজিক মাধ্যমে প্রচারণা চালিয়েছিল৷ সেখানে তারা এমনও বলার চেষ্টা করেছিল যে, বৌদ্ধ জনসংখ্যা কমাতে মুসলমানরা নাকি খাবার আর কাপড়ে ‘কন্ট্রাসেপ্টিভ' মিশিয়ে দিচ্ছে! মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে মুসলমানরোহিঙ্গাদের পালিয়ে যাওয়ার পেছনেও মৌলবাদী বৌদ্ধ ভিক্ষুদের একটি অংশের ভূমিকা রয়েছে৷
আর থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলের মুসলমানপ্রধান রাজ্যগুলোতে ২০০১ সাল থেকে মাঝেমধ্যেই সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে৷ ‘ব্যাংকক পোস্ট' দৈনিকের হিসেবে ২০০৪ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ঐ অঞ্চলে সহিংসতায় কমপক্ষে সাড়ে ছয় হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন৷ দেশটির দক্ষিণাঞ্চলে একটি স্বাধীন ইসলামি খেলাফত গড়ে তোলার লক্ষ্যে কয়েকটি ইসলামি জঙ্গি গোষ্ঠী সক্রিয় রয়েছে৷ সরকার তাদের কঠোরভাবে দমন করতে চায়৷ ফলে সহিংসতা তৈরি হয়৷ তবে মারা যাওয়া প্রতি দশজনের নয়জনই সাধারণ নাগরিক ছিলেন বলে জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ৷
শ্রীলংকা, মিয়ানমারের মতো থাইল্যান্ডের বৌদ্ধ ভিক্ষুরাও সংঘাতের একটি অংশ৷ ২০১৫ সালের অক্টোবরে থাইল্যান্ডের একজন জনপ্রিয় বৌদ্ধ ভিক্ষু ফেসবুকে বলেছিলেন, একজন বৌদ্ধ ভিক্ষুকে হত্যা করলে তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে একটি মসজিদ পুড়িয়ে দেয়া উচিত৷ এই ঘোষণার পর ঐ বৌদ্ধ ভিক্ষুকে সন্ন্যাসী সম্প্রদায় থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল৷
যুক্তরাষ্ট্রের ইয়ংসটাউন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মচর্চার অধ্যাপক মাইকেল জেরিসন ডয়চে ভেলেকে বলেন, শ্রীলংকা, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের বৌদ্ধরা আশংকায় আছেন৷ "এই তিন দেশের ভিক্ষুরা মনে করেন, বৌদ্ধ ধর্ম হুমকির মুখে আছে৷ ইসলাম আর মুসলমানরা তাঁদের দেশ দখল করে নেবে বলে আশংকা তাঁদের," বলেন তিনি৷ জেরিসন মনে করেন, মুসলমানদের নিয়ে বৌদ্ধদের এই ভয়ের কারণ অনেক পুরনো৷ মিয়ানমার আর শ্রীলংকা যখন ব্রিটিশদের অধীনে চলে গিয়েছিল, তখন বৌদ্ধ ধর্মের অস্তিত্ব নিয়ে শংকায় পড়েছিলেন ঐ দুই দেশের বৌদ্ধ অনুসারীরা৷ আর থাইল্যান্ড সেইসময় স্বাধীন থাকলেও প্রতিবেশী দেশগুলো ব্রিটিশ আর ফ্রান্সের অধীনে থাকায় সে দেশের বৌদ্ধরাও ধর্ম নিয়ে শংকায় ছিলেন৷ এই ভয়ের কারণে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় শ্রীলংকা আর মিয়ানমারের নাগরিকদের মনে জাতীয়তাবাদ আর ধর্ম রক্ষার বিষয়টি এক হয়ে ধরা দিয়েছিল, বলে মনে করেন জেরিসন৷ এখনও সেই ধারা বিদ্যমান৷ ফলে সেসব দেশে আজও ধর্মীয় পরিচয় আর জাতীয় পরিচয়কে আলাদা করা অসম্ভব বলে জানান তিনি৷ ‘‘মিয়ানমারের একজন সত্যিকারের নাগরিক হওয়া মানে হচ্ছে একজন বৌদ্ধ হওয়া,'' মন্তব্য জেরিসনের৷
এছাড়া পশ্চিমা বিশ্বের অনেক মানুষের মনে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে যে ধারণা গড়ে উঠেছে সেটিও ঐ তিন দেশের বৌদ্ধদের মনকে প্রভাবিত করছে বলে মনে করেন ধর্মচর্চার অধ্যাপক জেরিসন৷ "পশ্চিমের অনেক মানুষ বৌদ্ধ ধর্মকে শান্তিপূর্ণ মনে করে, আর ইসলামকে মনে করে সংঘাতের ধর্ম, যা আসলে সত্য নয়," বলেন তিনি৷
এবারে আসি, থাইল্যান্ডের পর্যটন শিল্পে মুসলিমরা কীভাবে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করছে নিয়মিত।
থাইল্যান্ড সম্পর্কে অনেকেরই খারাপ ধারণা আছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ থাইল্যান্ডে পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে যা প্রয়োজন সবই এখানে আছে। এত কিছুর পরও আশার কথা হলো, থাইল্যান্ডে সাম্প্রতিক সময়ে ‘আল ফাতুনি’ নামে একটি ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চালু হয়েছে ইসলামি ব্যাংক ‘ইসলামি ব্যাংক অব থাইল্যান্ড। ’ যার বেশিরভাগ গ্রাহকই হচ্ছেন অমুসলিম। আর ব্যাংকটির ডিপোজিটও সন্তোষজনক বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন। তা ছাড়া থাইল্যান্ডে হালাল ফুড ইন্ডাস্ট্রিও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিশ্বের সেরা ‘রেড বোল’ নামে এই পানীয়টিও হালাল ফুড ইন্ডাস্ট্রিজেরই একটি পণ্য।
আরও মজার বিষয় হলো, এখন থাইল্যান্ডের মসজিদগুলোও পর্যটকদের টানছে। অন ইসলামের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, থাইল্যান্ডে বেড়াতে যাওয়া প্রায় ১০ শতাংশ পর্যটক বেশ ঘটা করে ঐতিহাসিক মসজিদগুলো দেখতে যান। ফলে ওই সব মসজিদকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে খাবার ও হালকা শখের জিনিস বেচাকেনার দোকান।
থাইল্যান্ডে হালাল খাবারকে আরও জনপ্রিয় করতে সোমবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) ওই দেশে অবস্থিত কাতার দূতাবাসের উদ্যোগে হালাল খাদ্য প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। এ প্রদর্শনীর অবকাশে পবিত্র কোরআনে কারিম তেলাওয়াত প্রতিযোগিতার আয়োজন করে কর্তৃপক্ষ। বিভিন্ন গ্রুপে অনুষ্ঠিত এ কোরআন প্রতিযোগিতার বিচারকের দায়িত্ব ছিলেন থাইল্যান্ড ও আল আজহার ইসলামি কেন্দ্রের প্রতিনিধিরা।
থাইল্যান্ডে বসবাসরত মুসলমানদেরকে কোরআনে কারিম হেফজ, তেলাওয়াত এবং হাদিস পাঠের প্রতি উৎসাহ প্রদান ও গবেষণার প্রতি উৎসাহ দেওয়ার লক্ষ্যে প্রতিযোগিতাটির ব্যবস্থা করা হয়। এমন একটি সুন্দর অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্যে প্রতিযোগিতা আয়োজনকারীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন থাইল্যান্ডে নিযুক্ত কাতারের রাষ্ট্রদূত। ৫ টি গ্রুপে বয়সভিত্তিক এ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রতি গ্রুপের বিজয়ী প্রতিদ্বন্দীদের বিভিন্ন অংকের নগদ অর্থ পুরস্কার প্রদান করা হয়। থাইল্যান্ডে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মসজিদ (৩ হাজার ৪ শ’ ৯৪টি) রয়েছে। এর মাঝে প্রাচীন কয়েকটি মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রায় ৩শ’ বছর পূর্বে। এসব মসজিদের প্রায় সবগুলোর সঙ্গেই রয়েছে মাদ্রাসা। হাল সময়ে থাইল্যান্ডে তাবলিগের কাজ এগিয়ে চলছে প্রচণ্ড গতিতে।
রাজনৈতিক টানাপোড়েন সত্ত্বেও মুসলমানরা তাদের ধর্মীয় উৎসবগুলো অনেকটা স্বাধীনভাবেই পালন করতে পারেন। দুই ঈদে সরকারি ছুটি না থাকলেও ব্যক্তিগতভাবে খুব সহজেই ছুটি নেওয়া যায়। রোজার সময় এখানকার মুসলমানরা একসঙ্গে মসজিদে ইফতারের আয়োজন করতে পারেন। সেই সঙ্গে তারাবি ও ঈদের নামাজও। অনেক মসজিদে জুমার দিন খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। থাই মিষ্টি, ভাত, মুরগির মাংস, গরুর মাংস, বিভিন্ন রকমের ফল ও কোকাকোলা দিয়ে আগত মুসল্লিদের আপ্যায়ন করা হয়। এটা তাদের আন্তরিকতার প্রকাশই বটে। আমরা প্রত্যাশা করি, থাইল্যান্ডের মুসলমানরা পরস্পরে এমন আন্তরিকতা ও মমতায় জড়িয়ে থাকুক যুগ-যুগান্তর।
তথ্যসূত্র:
১। কালের কন্ঠ
২। জুমবাংলা
৩। উইকিপিডিয়া
৪। মানবজমিন
৫। ডি ডব্লিউ